খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কোথাও যাওয়া মানে আগের রাতের ঘুম উধাও। কিছুক্ষণের জন্য ঘুম এলো তবে তার ফেরার তাড়া-ই বেশী ছিলো।
ঘড়ির কাঁটা হয়তো ৭ ছুঁই ছুঁই। লিজনের অপেক্ষায় বংশাল মোড়ে আমি। লিজনকে নিয়ে গন্তব্য এখন কেরানীগঞ্জ, সেখান থেকে আরিফ ইলিয়াসকে নিয়ে গন্তব্য দক্ষিণে। ছোট এক ব্যাগে কাপড় চোপর নিয়ে তা কাঁধে চেপে আমাদের এবারের সফরসঙ্গী হয়েছেন রায়হান ভাই। যেখানেই পানি পাবেন সেখানেই তিনি সাঁতরাতে নামবেন।
মাওয়া এক্সপ্রেস হয়ে গাড়ী ছুটছে মাস দুয়েক আগে উদ্বোধন হওয়া পদ্মা সেতুর দিকে। ২০-২৫ মিনিটেই আমরা পৌঁছলাম পদ্মায়। ৫-৬ মিনিটে যখন প্রমত্তা পদ্মা পারি দিলাম তখন কয়েক মাস আগে সারা শীতের রাত মাওয়া ঘাটে অপেক্ষা করে সকালে ফেরিতে পদ্মা পার হয়ে খুলনা যাওয়ার ঘটনা বহু পুরনো অতীত মনে হলো।
ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা – গাড়ীতে এই রাস্তায় চললে আরামে বসে চা কফি খেয়ে নেয়া যায়। রাস্তা এতই মসৃণ যে ছিটেফোঁটা জামায় লাগার কোন সুযোগ নেই।
ড্রাইভার রাস্তা চিনলেও গুগোল ম্যাপ দেখে পাণ্ডিত্য দেখানো আমাদের সকল ট্যুরের অভ্যাস। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বটা ইলিয়াসই নেয় সব সময়। খুলনা যাওয়া আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলেও দক্ষিণের আরও কিছু জেলা ঘুরে দেখাও আমাদের ইচ্ছা।
মাদারীপুরের রাজৈর রোড ধরে যাচ্ছি, উদ্দেশ্য গোপালগঞ্জ।
রাজৈর থেকে গ্রামের আকা বাঁকা পথে গাড়ী যখন গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার দিকে যাচ্ছে তখন দুই পাশের সবুজ ক্ষেতগুলোতে সকালের সূর্যের আলো এক অপরূপ সৌন্দর্য দিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় সবুজের মাঝে ছোট ছোট জলাশয়গুলো রোদের আলোতে চিকচিক করছে।
কোটালিপাড়ায় আমাদের যাত্রা বিরতি। রায়হান ভাইয়ের মতে কোন গ্রামে এলে সেখানকার মিষ্টির স্বাদ যাচাই করে দেখতে হয়। আমি, রায়হান ভাই আর ইলিয়াস মিষ্টির দোকান পছন্দ করায় ব্যস্ত হলাম। আরিফ আর লিজন ভাতের হোটেলের খোজে। দুই দলে ভাগ হয়ে দুই হোটেলে চললো নাস্তার পর্ব।
গন্তব্য এখন টুঙ্গিপাড়া। গ্রাম হিসেবে টুঙ্গিপাড়া দশে দশ। দিগন্তজোড়া সবুজ আর স্বছ পানির জলাশয়ে ভরপুর। এখানেই জন্মেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। গোপালগঞ্জ ঘুরে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে তার কবর জিয়ারত করে যাওয়া।
বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারতের পরে এখন আমাদের উদ্দেশ্য বাগেরহাট। সরু সরু রাস্তা ধরে গ্রামের হাট বাজারগুলো পেছনে ফেলে আমরা ছুটছি। ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তার দুই পাশের চিংড়ির ঘেরগুলো সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।
খান জাহান আলীর মাজারে আমরা। মাজার কেন্দ্র করে চলছে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম ব্যবসা। মাজার জিয়ারত শেষে সামনের পুকুরের কুমির দেখার দিকে এগোলাম আমরা। সুবিশাল পুকুর, অনেকেই গা ডুবিয়ে গোসল করছেন। কুমির থাকা পুকুরে এটা কিভাবে সম্ভব! তাজ্জব ব্যাপার!
মূল পুকুরে আসলে কুমির নেই। এ নিয়েও আছে ব্যবসা, কুমির দেখাদেখির ব্যবসা। পুকুর ঘেষা এক বাড়িতে প্রাচীর দিয়ে কুমিরগুলোকে আটকে রাখা হয়েছে সেখানে।
সেই বাড়ির খোজে আমরা। বাড়ির সামনে বড় করে লেখা “এখানে কুমির দেখা যায়”।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই একজন আমাদেরকে পুকুরের সামনে নিয়ে গেলো। সেখানে কুমিরের উপস্থাপক আছেন একজন। কুমিরের খাবারের জন্য কিছু টাকা দিলে তিনি কুমিরকে ডেকে দিবেন, থাকবে কুমিরের সাথে ছবি তোলার সুযোগ। টাকা পয়সার দেন দরবার হলো। ডাকা হলো কুমিরকে। কচুরিপানার ঝাঁক ঠেলে দুজন মাথা উঁচু করলেন। উপস্থাপকের সাহায্যে রায়হান ভাই আর লিজন কুমিরের সাথে ছবি তোলার পর্ব সারলেন। কুমিরের হঠাত মানুষ খাওয়ার শখ জেগে যায় কিনা সেই ভয়ে আমি ইলিয়াস আর আরিফ সেই ঝুঁকি নিলাম না।
কিছুক্ষণ পরে আমরা যখন ষাট গম্ভুজ মসজিদে পৌঁছলাম তখন জোহরের সময় হয়েছে। ঐতিহাসিক এই মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার সুযোগটা আমরা হাত ছাড়া করলাম না।
পাশেই বাগেরহাট যাদুঘর। এক কাপ গরম চা খেয়ে শেষ করার আগে এই যাদুঘর দুইবার ঘুরে শেষ করা যায়। যাদুঘর ঘুরে আমরা যাচ্ছি খুলনা, আমাদের আসল গন্তব্য। খুলনাতে চুইঝাল খাবো। খুলনার দুই দোকানের চুইঝাল খুব বিখ্যাত। ১) চুকনগরে আব্বাসের হোটেল ২) জিরো পয়েন্টে কামরুলের হোটেল। আব্বাসের হোটেল খুলনা শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় আমরা কামরুলের হোটেলে থামলাম। আব্বাসের চুইঝাল আগে খেয়েছি। কামরুলও হতাশ করলো না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পরেছে। এখনই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলে পদ্মা সেতুর কল্যাণে সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে ঢাকায়। এত জলদি কেউ ফিরতে রাজি হলো না। সাতক্ষীরা নাকি মংলা – বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত এক মতে পৌঁছে আমরা ছুটলাম মংলার দিকে। মংলা বন্দর দেখে ফিরবো ঢাকায়।
মংলা পৌঁছলাম। এদিক সেদিক ঘুরে একটা ছোট ট্রলার নিয়ে আমরা যাচ্ছি সুন্দরবন।
সুন্দরবন?
হ্যাঁ, সুন্দরবন। আমরা নিজেরাও বিশ্বাস করতে পারছিনা যে আমরা সুন্দরবন যাচ্ছি। শান্ত নদী আস্তে আস্তে গিয়ে মিলেছে সমুদ্রে। বন্দর আর নদীর মাঝে নোঙ্গর করে রাখা জাহাজ পেছন ফেলে আমরা যাচ্ছি আরও গভীরে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে গভীর বন। আস্তে আস্তে তা আরও গভীর হলো। ভয়ংকর রূপ নেয়া নদী দুই পাশের বন ভেদ করে চলে গেছে মাঝখান দিয়ে।
সুন্দরবনের করমজল পয়েন্টে থামলাম আমরা। এখানে থাকা বন বিভাগের কর্মকর্তারা এগিয়ে এলেন আমাদের ট্রলারের দিকে। সুন্দরবনে এখন পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা চলছে। নিষেধাজ্ঞার সময় প্রায় শেষ হওয়ার পথে, আর হয়তো ১০-১২ দিন পরেই আবার খুলে দেয়া হবে পর্যটকদের জন্য। ঢাকা থেকে এত দূর এসে আবার ফিরে যাবো আর নিষেধাজ্ঞা শেষেরও খুব বেশী দিন বাকি না থাকায় সেখানে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা আমাদেরকে বনে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। নির্দিষ্ট ফি জমা দেয়ার পরে একজন নিরাপত্তা কর্মী সহ আমরা ঢুকলাম বনে। শেষ বিকেলে বন ভয়ংকর। বেশ ভয়ংকর। অচেনা বহু পাখির ডাক সেই ভয়ংকর পরিবেশকে অন্য মাত্রায় নিয়েছে। হরিণের দেখা মিললো বনে। বন কর্মকর্তা আমাদেরকে বহু গাছ চেনালেন, শোনালেন তার অভিনয় জীবনের গল্প, দেখালেন ছবি তোলায় তার হাত কত পাকা! সন্ধ্যা নামার ক্ষণে বনের পরিবেশ ভয়ানকতার ডালপালা ছড়ালো।
পশ্চিমে সূর্য পুরোপুরি হেলে পরেছে। ট্রলারে করে আমরা রওনা হলাম মংলার উদ্দেশ্যে। ঢেউ বেড়েছে, ঢেউয়ের পানি ট্রলার আছড়ে শরীরে ছিটে দিয়ে যাচ্ছে। সাঁতার না জানা আমি ভয় পাচ্ছি সবচেয়ে বেশী।
সমুদ্রে আজ ৩ নং বিপদ সংকেত ছিলো, লিজন ট্রলারে করে সুন্দরবন যেতে রাজি ছিলো না। এই সব ভয় চেপে যখন মংলা বন্দরে ফিরে এলাম তখন সুন্দরবন ঘুরে আসার আনন্দের কাছে এসব ভয় ফিকে হয়ে গেলো।
গন্তব্য এবার ফিরে যাওয়া। ঢাকা। তবে ফিরতে ইচ্ছে করছে না কারো। বরিশাল নাকি নড়াইল কোথায় যাওয়া যায় সেই হিসাব মেলাতে মেলাতে আমরা ফিরলাম ঢাকায়।
শেষ হলো একদিনে দখিন দেখা।