দেড় দিনের ভ্রমণ

(আমরা ৬ বন্ধুর মধ্যে ৩ জনের নাম ই আরিফ।
আমি আরিফ হোসেন, একজন আরিফুল ইসলাম আরিফ, আরেকজন সিরাজুল ইসলাম আরিফ। এখানে আরিফ বলে আরিফুল ইসলামকে ডাকা হয়েছে।)

অনেক দিন আগের কথা হলেও যেন এই গতকালের মনে হয়।

ঢাকা শহরের যান্ত্রিক জীবনে কিছুটা স্বস্তি আসে দুই ঈদের কিছুটা সময়ে। তেমনই কোন এক কুরবানীর ঈদের সময়ের ঘটনা। সন্ধ্যার পর বন্ধুরা মিলে বসলাম ঈদ এর করনীয় ঠিক করতে । আমি , সিরাজ , আরিফ, লিজন আর ইলিয়াস । ডাক্তার বন্ধু (তখন সে ডাক্তারি পাশ করে নাই ) জোহান পারিবারিক কাজে আটকা ,তাই আসতে পারে নাই । কম খরচে আশে পাশে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা হচ্ছে । হঠাত কেউ একজন বলল – শ্রীমঙ্গল গেলে কেমন হয় ! তরুণ মন উতলে উঠল ! বুদ্ধি খারাপ না।
সিদ্ধান্ত হল।
আজকে রাতের ট্রেনেই যাচ্ছি আমরা।
কিন্তু জোহান? বেচারা অনেক চেষ্টা করেও আসতে পারল না।

যে যার বাড়ি গেলাম টাকা পয়সা সহ কিছু জিনিস গুছিয়ে নিতে।

সিরাজ তার বাড়ি থেকে সব গুছিয়ে দৌড়ে গেল ওর স্টুডেন্ট এর বাসায়, ডিজিটাল ক্যামেরা জোগাড় করতে! তখনো সবার কাছে স্মার্ট ফোন সেভাবে ছড়ায় নাই, বাটন ওয়ালা মোবাইলে হয়ত তখন ২-১ মেগাপিক্সেল এর ছবি উঠতো।

একটা সিএনজি চেপে রওনা এবার কমলাপুর রেল স্টেশন। চোখে মুখে উদ্দীপনা আর পকেটে বাতাসের আনাগোনা। আমার পকেটে শ পাঁচেকের একটু বেশি, বাকি সবারও প্রায় একই।

স্টেশনে নেমে আমরা সিলেট যাওয়ার ট্রেনের খোঁজ করলাম। শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি না, শ্রীমঙ্গল যেতে পারলে আরেকটু এগিয়ে সিলেট কেন নয়!

আজকে সিলেটের ট্রেন নাই। আর থাকলেই কি! ঈদের মৌসুমে টিকেট তো থাকবে না। একটা মেইল ট্রেন আছে সেটা কালকে বিকেল নাগাদ সিলেট পৌঁছবে। দৌড়ালাম বাস কাউন্টারের দিকে। নাহ, ঈদ এর মৌসুম তাই বাসেরও টিকেট নাই। একজন পরামর্শ দিল – কোনভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যেতে , সেখান থেকে সিলেট যাবার ব্যাবস্থা করা যাবে। সিলেটের সেই মেইল ট্রেনের ৫ টা টিকেট করলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত যাবো।

ট্রেনের ভিতরটা অন্ধকার, বসার সিট নাই , খবরের কাগজ বিছিয়ে বসলাম ট্রেনের দরজায়।ট্রেন ছাড়ার কোন খবর নাই, পাশে আরো কিছু ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। আমি,সিরাজ আর আরিফ কিছুটা পায়চারি করছিলাম প্লাটফর্মে। দু একজনের সাথে কথা বলে জানলাম আমাদের কাটা টিকেটে আমরা চট্টগ্রামগামী এক ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতে পারবো যেটা আগে ছেড়ে যাবে। আমরা ট্রেন বদল করলাম। এই ট্রেনে আলো আছে, হলুদ আলো, তবে বসার সিট নাই এবং এটাও ছাড়ার খবর নাই। আবার আমাদের পায়চারি শুরু। আমি, সিরাজ আর আরিফ গিয়ে বসলাম পাশে দাঁড়ানো চট্টগ্রামগামী আরেক আধুনিক ট্রেনে। ঝকঝকে আলো এই ট্রেনে, সেই ট্রেনের ক্যান্টিনে বসে বুদ্ধি আসলো এটাও যেহেতু চট্টগ্রাম যাবে তাহলে আমরা এই ট্রেনে করেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যাই! তবে আমাদের কাটা টিকেটে এই ট্রেনে ভ্রমণ চলবে না। সিরাজ এর দায়িত্ব যেভাবেই হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করা।

সিরাজ সফল! ক্যান্টিন বয় কে ম্যানেজ করে ফেলেছে সে! ক্যান্টিনে বসেই ছুটলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

রাত আনুমানিক তিনটা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনে নামলাম। চারপাশ অন্ধকার। দুই একটা হোটেলে তখনো বেচা বিক্রি হচ্ছে। পেটে কিছু দানা পানি পড়লো।

স্থানীয়রা জানালো সকাল ছাড়া সিলেটের বাস নাই। আর থাকলেই কি? পকেটে তো তেমন টাকা পয়সা নাই। সুলভ মূল্যে যাবার একটাই উপায় – এখান থেকে কিছু দুরে আখাউরা রেল স্টেশন। সেখান থেকে ভোর ছয় টায় লোকাল ট্রেনে সিলেট।

তো এখন আখাউরা যাবার উপায় কি? আগে জানা থাকলে আমরা যে ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসেছি সেটাতেই একবারে আখাউরা যাওয়া যেত।
এখন একটাই উপায়। একটু পরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী একটা ট্রেন এখানে থেমে আখাউরা যাবে। কমলাপুরে প্রথমবার ট্রেন বদল করে যে হলুদ আলোর ট্রেনে চড়েছিলাম, সেটাই এই ট্রেন। এটা মিস করলে উপায় আর নাই। ট্রেন এসে থামল। সিরাজের দায়িত্ব চেকারকে ম্যানেজ করা। তবে খুব দ্রুত করতে হবে, কেননা ট্রেন এখানে কয়েক মিনিটের জন্যই দাঁড়াবে।
সিরাজ সফল! চেকারকে কিছু টাকা দিয়ে ট্রেনে উঠার ব্যাবস্থা করেছে সে। কিন্তু উঠার কোন উপায়-ই নাই। ট্রেন লোকে লোকারণ্য। দৌড়ে গেলাম ট্রেনের মাথায়। ইঞ্জিন এর পাশে ঝুলে রইলাম পাঁচ জন।

সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল কি না সেটা মনে নাই, কোন অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমার রাত কিনা সেই খেয়ালও নাই, কেননা তখন আমরা এমন ভাবে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি যখন হাতটা একটু এদিক সেদিক হলেই শেষ। মাঠ ঘাট নদী ফেলে ঝাঁকুনি দিয়ে ছুটে চলছে ট্রেন।

আখাউরা যখন নামলাম তখন রাত প্রায় শেষের দিকে। রেল লাইনে বসে রীতিমত কাদতেসে আরিফ। ট্রেনে ঝুলে পুরো রাস্তা তার বাবা মা’র কথা ভেবেছে সে।

রাত শেষে সূর্যের উঁকি দেয়া দেখলাম স্টেশনে বসেই। ভোর হল, কাউন্টারের দোর খুলল। সকাল ছয়টার কুশিয়ারা ট্রেনে উদ্দেশ্য এখন শায়েস্তাগঞ্জ। ঢাকা শহরের ৭ নাম্বার বাসের মত থেমে থেমে ৮ টায় পৌঁছল শায়েস্তাগঞ্জ।

বাসে উঠলাম। সিলেট যাচ্ছি। ক্লান্ত দেহ তখন নিদ্রাছন্ন।

প্রায় দশ টায় আমরা সিলেট পৌছলাম। আসার সময় যে অভিজ্ঞতা হল ফেরার বেলায় যেন সেটা না হয় তাই প্রথমেই রেল স্টেশনে গেলাম ফেরার টিকেট কাটতে।

নাহ! ঈদ মৌসুম, কোন টিকেট নাই। ফেরার কোন অগ্রিম বন্দোবস্ত করা গেল না।

সিএনজিতে শাহজালাল মাজারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। সিরাজ সিএনজি ড্রাইভার কে বোঝানোর চেষ্টা করল যে আরিফের গার্লফ্রন্ড প্রেমের সম্পর্ক শেষ করে দিসে। ওর মন খুব খারাপ। আমরা তাই কিছু না ভেবে ওর মন ভাল করতে সিলেট চলে আসছি। এখন চাচা যদি একটু হেল্প করেন তাহলে ভাতিজারা খানিকটা জাফলং ঘুরতে যেতে পারি। চাচা তেমন কিছু করলেন না।

পকেটে টাকা পয়সা প্রায় শেষের দিকে, সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার তাই একসাথে সারলাম। শাহজালাল এর মাজার জিয়ারত করা হল। তারপর কি করার? সিলেট যেহেতু এসেই পরলাম জাফলংটা না দেখে গেলেই নয়! সিরাজ এর দায়িত্ব কম মূল্যে সিএনজি ব্যাবস্থা করা।

সিরাজ লাল মিয়া নামক এক সিএনজি ড্রাইভার ভাইকে জোগাড় করসে। সে জাফলং তামাবিল ঘুরিয়ে রাতে স্টেশনে পৌঁছে দিবে।

যাত্রা এবার জাফলং। পিচঢালা আর কোথাও ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে যখন আমরা জাফলংয়ের দিকে ছুটছি তখন পাশে ফেলে যাওয়া পাহাড়, ঝরনা আর নদীতে চোখ মজলো কিন্তু এমন সৌন্দর্য সারা জীবন দেখলেও কি মন মজবে?!

জাফলং আর তামাবিল ঘোরা হল। বিপত্তি বাঁধল সেখান থেকে স্টেশনে ফেরার সময়। সিএনজির লাইট নষ্ট। সারা রাস্তা লিজন আর ইলিয়াস মোবাইলের লাইট জ্বেলে লাল মিয়াকে পথ দেখাচ্ছে।

স্টেশনে নামলাম। রাস্তার পাশের হোটেলে ভাত খেতে বসলাম, হাত ধুতে হবে গুড়া সাবানে। এখানে এর বেশি ব্যাবস্থা নাই।

পকেট পুরোপুরি শূন্যের কোটায়। এবার সিরাজ এর দায়িত্ব ঢাকাগামী ট্রেনের মাস্টারকে ম্যানেজ করা। ঈদ এর মৌসুম ট্রেনের টিকেট পাবার তো প্রশ্নই উঠে না। সারা রাস্তা ট্রেনে দাড়িয়ে গেলেও টিকেট এর দাম জনপ্রতি ২৫৫। অত টাকা নাই।

সিরাজ এবারও সফল। ৮০০ টাকায় সে পাঁচ জনের ঢাকা যাবার ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। দাড়িয়ে কিংবা বসে নয়, একদম শুয়ে। ট্রেনের নামাজের বগিতে।
পরদিন সকালে পকেটে ১০ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরলাম ।

তারপর বহুকাল পার হয়েছে। আজকের শেষ বেলায় যখন এই লেখা লিখছি তখন মনটা পড়ে আছে সেই জাফলংয়ের পাহাড়ে, অরণ্যে আর পাহাড় বেয়ে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির ধারায়।
বহু শহরে বহু ভ্রমণ আমি করেছি। কিছুটা দেশের বাইরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও রয়েছে, তবে উপরে বর্ণনা করা এই ভ্রমণ মনের ভেতর অন্য রকম একটা জায়গা করে আছে।