হাওড়ে ঈদ।

(আমরা ৬ বন্ধুর মধ্যে ৩ জনের নাম ই আরিফ।
আমি আরিফ হোসেন, একজন আরিফুল ইসলাম আরিফ, আরেকজন সিরাজুল ইসলাম আরিফ। এখানে আরিফ বলে আরিফুল ইসলামকে ডাকা হয়েছে।)
ঈদের পরদিন। সকাল প্রায় ৭ টা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি কিছুটা শঙ্কা জাগালো মনে। হাওড় দেখার ইচ্ছেটা কি তবে ভেস্তে দিলো বৈশাখের এই বৃষ্টি!
আরিফের সাথে ফোনে কথা হলো, সে-ও জানালো একই শঙ্কা। তবু দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম বের হওয়ার। বৃষ্টি মাথায় করে আমি ইলিয়াস আর আরিফ রওনা হলাম ঢাকা থেকে। ময়মনসিংহ থেকে সরাসরি কিশোরগঞ্জ যাবে সিরাজ, যেখানে আগে থেকেই আছে লিজন। ডাক্তার বন্ধু জোহান তার পেশাগত দায়িত্ব সামলাচ্ছে তার নতুন কর্মস্থল কক্সবাজারে।
পিচঢালা হাইওয়ে আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঈদের ফাঁকা রাস্তাকে একটা অন্যরকম সৌন্দর্য দিয়েছে। হাতের মোবাইল ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আমরা পৌঁছলাম কিশোরগঞ্জ। সকালের নাস্তা শেষে আমরা যখন নতুন ভাবি সহ হাওরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ঠিক তখন এক দুর্ঘটনার সংবাদে লিজন আর ভাবি আমাদের সঙ্গী হতে পারলো না। আমরাও একটা দোটানায় পরে গেলাম কোথায় যাওয়া যায় সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে! কেননা লিজনই আমাদেরকে মিঠামইন হাওর সহ বেশ কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর কথা।
প্রথমেই যে নামটা আমাদের মাথায় এলো সেটা – ‘সিলেট’। বেশ কিছু পথ গাড়ি চললো তবে কোথায় যাবো সে সিদ্ধান্ত হলো না।
অবশেষে নিজেরাই মিঠামইন যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
বালিখোলা পৌঁছে ফেরির জন্য লম্বা সারি দেখে যখন এই ট্যুরটাই ভেস্তে যাবার পরিক্রম তখন কোন ভাবে আজকের কিশোরগঞ্জ আসাটাকে সার্থক করতে সিদ্ধান্ত নিলাম নৌকা ভাড়া করে এদিক ওদিক ঘোরার।
ইঞ্জিন চালিত এক নৌকায় উঠলাম আমরা চারজন।
ঈদ উপলক্ষে ছেলে বুড়োদের অনেকগুলো ছোট ছোট দল নৌকা ভাড়া করে গান বাজনা বাজিয়ে ঘুরছে। আমরা নৌকা নিয়ে একটু অন্য পথে এগোলাম। হালকা ঢেউয়ে আমাদের নৌকা যখন বহু দূর এগিয়েছে পারের কোলাহল আর গান বাজনার আওয়াজ তত দূরে সরে গিয়েছে।
টিন আর বেড়ার তৈরি বেশ কিছু বাড়ি চোখে পড়লো নদীর পারে। ছোট ছোট নৌকা বাধা রয়েছে সেই বাড়িগুলোর ঘাটে। হয়তো ঈদ উপলক্ষে সেই সব বাড়িঘরে আনাগোনা বেড়েছে সেসব বাড়ির স্বজনদের।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা থামলাম একটা চরে। দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ, যতদূর চোখ যায় ততদূরই সবুজ আর পাশে বয়ে গেছে নাম না জানা এক নদী। এ যেন এক অন্য রকম সৌন্দর্য এনে দিয়েছে এই চরকে।

একটু আগে বাড়তেই মেঠো পথ, তা ধরে হাঁটছি। হঠাত চোখ আটকে গেলো হাঁসের এক বিশাল ঝাঁক দেখে। ১০-১২ বছরের এক কিশোর প্রায় সাড়ে আটশো এই হাঁসের দলকে সামলাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে ততক্ষণে বিকেল। টিনের চালের বেশ কয়েকটি ঘর চোখে পড়লো। কয়েকজন কৃষক ধান মাড়ানো কিংবা শুকানোর কাজ করছে। কৃষকের বাড়িতে দুপুরের খাবারের একটা ইচ্ছে জাগলো। সেখানে থাকা এক কৃষককে আমাদের দুপুরের খাবারের কথা বলতেই তিনি ছুটে গেলেন তার বাড়ির দিকে – আমাদেরকে খাওয়ানোর মতো পর্যাপ্ত খাবার আছে কিনা তা দেখতে। কিছুক্ষণ পর এসে তিনি অনেকটা জোর করেই তার বাসায় নিয়ে গেলেন কেননা আমাদের ইচ্ছে ছিল বাড়ির বাইরে গাছতলায় বসে খাবো।
বাড়িতে গিয়ে দেখি পরিপূর্ণ ভাবে মেহমানদারির জন্য প্রস্তুত ছোট খাবারের টেবিলটি। যাদের পরিশ্রমের ফসলে আমাদের টেবিলে দামি খাবারের পসরা সাজে সেই কৃষকের বাড়িতে ঈদেও খুব সাদামাটা আয়োজন। সাদামাটা সেই আয়োজন যতটানা ক্ষুধার তৃপ্তি মেটালো তার চেয়ে বেশী মেটালো মনের তৃপ্তি। একজন দরিদ্র কৃষকের যে সে কি আপ্যায়ন তা ক্যামেরায় যেমন বন্দী করাও সম্ভব না তেমনি সম্ভব না তা লিখে প্রকাশ করতে।

ঈদের লম্বা ছুটিতে আমরা যখন বহু কিছুর পরিকল্পনায় ব্যস্ত তখন এই কৃষকেরা ছুটিবিহীন এক কর্মযজ্ঞে সব সময় ব্যস্ত। বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নামছে। চরের সৌন্দর্য যেন আরও ডাল পালা মেলে ছড়াচ্ছে। যেমন চঞ্চল এক মন নিয়ে এই চরে এসে নেমেছিলাম ঠিক তার বিপরীত – উদাসীন এক নিশ্চুপ মন নিয়ে ফিরে এলাম নৌকায়। কিছু পরে ঢাকায়, মায়ার নগরীতে, যান্ত্রিক ভাবে চলার প্রস্তুতি নিয়ে কিছু দিন পর কাজে ফিরবো। বিকেলের চায়ের অবসরে কিংবা ঢাকার জ্যামে বসে মন ফিরে যাবে আবার সেই দিগন্তজোড়া মাঠে, কৃষকের ক্ষেতে, কৃষকের সেই উঠানে, সেই নড়বরে খাবার টেবিলে কিংবা শাখা প্রশাখা গজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাছতলায়।